
হুজ্জতুল ইসলাম মুজাফ্ফরী বলেন— হযরত ফাতিমা (সা. আ.)-এর শাহাদত কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়; এটি ইসলামী চিন্তাধারার এমন এক বাস্তবতা যা মানুষ, ঈমান ও ন্যায়ের সম্পর্ককে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে। তিনি বলেন, “স্বল্প জীবনে হযরত ফাতিমা (সা. আ.) বুদ্ধি ও ভালোবাসার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছেন, এবং এমন এক জীবনধারা উপহার দিয়েছেন যেখানে জ্ঞান, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা একে অপরের পরিপূরক।”
ইকনা’র “চিন্তাধারা বিভাগ” এই উপলক্ষে একটি বিশেষ ফাইল উন্মোচন করেছে, যেখানে ধর্মতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হযরত ফাতিমা (সা. আ.)-এর চিন্তা ও উত্তরাধিকার নিয়ে গবেষক ও চিন্তাবিদদের মতামত তুলে ধরা হচ্ছে।
ইমামত ও ফাতিমি দৃষ্টিভঙ্গি
মুজাফ্ফরী বলেন, “হযরত ফাতিমা (সা. আ.)-এর ইমামতের পক্ষে অবস্থান কেবল আত্মীয়তার কারণে নয়, বরং আল্লাহপ্রদত্ত দিকনির্দেশনা রক্ষার জন্য সচেতন এক প্রচেষ্টা।”
তিনি বলেন, “হযরত ফাতিমা (সা. আ.) বলেছেন— ‘যে আল্লাহর জন্য খাঁটি ইবাদত করে, আল্লাহও তার জন্য সর্বোত্তম কল্যাণ নির্ধারণ করেন।’ এই বক্তব্য মানবজীবনের পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে, যেখানে খাঁটি ইবাদতই মানসিক প্রশান্তি ও পথনির্দেশের মূল।”
তাঁর মতে, ফাতিমা (সা. আ.)-এর সামাজিক প্রতিবাদ আসলে রাজনৈতিক নয়, বরং তাত্ত্বিক ও ধর্মীয় ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এক “ইমামত ব্যাখ্যা আন্দোলন”।
তিনি বলেন, “ইতিহাস বিকৃত করে ফাতিমা (সা. আ.)-এর প্রতিবাদকে পারিবারিক বিরোধ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, অথচ বাস্তবে এটি ছিল নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা রক্ষার সংগ্রাম।”
কুরআনের প্রতি আশ্রয় ও যুক্তি
হুজ্জতুল ইসলাম মুজাফ্ফরী বলেন, “হযরত ফাতিমা (সা. আ.) কুরআনের আয়াতের ওপর নির্ভর করে ইমামতের যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে, যে কোনো ধর্মীয় সত্য যদি কুরআনে ভিত্তি না পায়, তা আল্লাহর দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই তাঁর প্রতিবাদ ও বক্তব্য ছিল যুক্তি, জ্ঞান ও ওহির সমন্বয়ে গঠিত।”
তিনি আরও বলেন, “ফাতিমা (সা. আ.)-এর ইমামত ধারণা মূলত নবুওয়াতের অব্যাহত রূপ— অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশে নিযুক্ত ইমামই মানবজাতির পথনির্দেশক।”
ইমাম: রাজনীতিক নয়, বরং “হুজ্জতে খোদা”
মুজাফ্ফরী বলেন, “হযরত ফাতিমা (সা. আ.)-এর মতে, ইমাম কেবল রাজনৈতিক নেতা নয়, বরং পৃথিবীতে আল্লাহর হুজ্জত। তিনি এমন এক সত্তা যিনি আল্লাহর নির্দেশ ও জ্ঞানের মাধ্যমে মানবতার নেতৃত্ব দেন।”
তিনি সূরা বাকারাহর আয়াত (১২৪) উদ্ধৃত করে বলেন, “إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا” — আল্লাহ নিজেই ইমাম নিযুক্ত করেন; এটি মানুষের নির্বাচন নয়।”
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, “ফাতিমি দৃষ্টিকোণ থেকে ইমামত মানে এমন নেতৃত্ব, যা নবুওয়াতের জ্যোতিতে আলোকিত, এবং যার অনুপস্থিতিতে সমাজ দিকহীন হয়ে পড়ে।”
সমসাময়িক প্রজন্মের জন্য ফাতিমি বার্তা
“আজকের মানুষ বস্তুবাদে ডুবে আছে, অথচ ফাতিমা (সা. আ.)-এর বার্তা আমাদের কুরআনের গভীরে ফিরে যেতে আহ্বান জানায়,” বলেন মুজাফ্ফরী।
তিনি যোগ করেন, “যে সমাজ কেবল কুরআন পাঠে সীমাবদ্ধ নয় বরং এর মর্মে চিন্তা ও প্রতিফলন করে, সেই সমাজই প্রকৃত ‘কুরআনিক সমাজ’। ফাতিমা (সা. আ.)-এর আহ্বান হলো এমন নেতৃত্ব বেছে নেওয়া, যে নিজেই হিদায়তের উৎস, অন্যের দিকনির্দেশনার মুখাপেক্ষী নয়।”
ইমামবিহীন সমাজের পরিণতি
মুজাফ্ফরীর মতে, “ইমামবিহীন সমাজ হলো এক ভ্রান্ত সমাজ— হয় ঈমানহীন, নয়তো ভুয়া নেতৃত্বের অনুসারী। সূরা কাসাস (৪১)-এ আল্লাহ বলেছেন: এমন কিছু নেতা থাকবে যারা মানুষকে জাহান্নামের দিকে টেনে নিয়ে যাবে।”
তিনি বলেন, “ফাতিমা (সা. আ.)-এর চিরন্তন বার্তা হলো— ‘ইমামতই হিদায়তের স্তম্ভ’; ইমাম ছাড়া সমাজের পথ হারিয়ে যায়।”
মুজাফ্ফরী বলেন, “ইমামত আল্লাহপ্রদত্ত একটি পবিত্র দায়িত্ব। যেমন নবুওয়াত মানুষের নির্বাচিত নয়, তেমনি ইমামতও নয়। নবীর পর এই দায়িত্ব উত্তরাধিকার সূত্রে নয়, বরং আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তির মাধ্যমে অব্যাহত থাকে।”
তিনি উল্লেখ করেন, “হযরত ফাতিমা (সা. আ.) জীবনের শেষ মুহূর্তেও বলেন— ‘এই উম্মত আমাদের সেই অধিকার কেড়ে নিয়েছে, যা আল্লাহ আমাদের জন্য নির্ধারণ করেছিলেন।’”
তার মতে, ফাতিমি দৃষ্টিতে ইমামত নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা, এবং এর বিচ্ছেদ মানেই হিদায়তের অন্ত। সমাজের স্থিতি ও ন্যায়বিচার টিকিয়ে রাখতে আল্লাহর নিযুক্ত ইমামই একমাত্র আশ্রয়।
প্রতিবেদন: হাদিসে মুনতাজারি
4314012#